আমাদের বাড়ির পাশে বড় বিল, সেই বিলের মাঝ দিয়ে কাঁকশিয়ালী নদী আর পায়ে হাঁটা পথ পাশাপাশি চলে গেছে। সেই পথ ও নদীর এক জায়গায় কতকগুলো কেওড়াগাছ নিয়ে মদিনার দরগা। মদিনার দরগায় আমার এক চিলতে শৈশব পড়ে আছে। সেই স্মৃতি দেখতে আজ প্রায় তেত্রিশ বছর পর আবার গিয়েছিলাম। ছোটবেলায় দেখেছি, পথটি বড় নির্জন ছিল। কাঁচা পথ, পায়ে হাঁটার মতো সরু রেখা ছিল ভেড়িবাঁধের ওপর, কত উঁচু ছিল। পূব দিকে গোবিন্দকাটি গ্রাম, পশ্চিমদিকে কালীগঞ্জ। এই দুই এলাকার মধ্যে যাতায়াত করত দু একজন। শীতের সকালে ধোঁয়া ধোঁয়া রোদের ওম ঝরত। পথের একপাশে বাবলা গাছের সারি, আরেক পাশে তো কাঁকশিয়ালীর কুলকুল করে বয়ে চলা। গাঙ শালিকের কিচিরমিচির ভেসে আসত, সে এক মধুর নির্জনতা। আজ দেখলাম, সেই ভেঁড়ি বেশ নীচু হয়ে গেছে। এত নীচু যে, নদীতে একটু জলের তোড় এলেই গ্রাম, বিল তলিয়ে যাবে। নির্জনতাটুকু মাঝে মাঝে নষ্ট হয়েছে, মানুষের কর্মকাণ্ড ঢুকে পড়ার দরুন। তবুও সেই শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এখনও অনেকটা আছে। মদিনার দরগার ওখানে একটা পাকা মন্দির মতো ছিল, তা এখনও আছে, তবে সেই কেওড়াগাছগুলো নেই।
যা দেখলাম, তাই অনেক। শৈশবের স্মৃতি আজ নিতে
গেলাম, আজকের দিনটাও স্মৃতি হয়ে যাবে।
ভারি আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে, নদীর পাড়,
খালের পাড় দখল করে নিয়েছে মানুষ! নদী, খাল তার তীরকে যে অনুসঙ্গ দান করে, মাঝখানে মানুষ
এসে সে দানখানিকে নিতেও দিচ্ছে না, দিতেও দিচ্ছে না। প্রকৃতির নিরিখে এ ঘোরতর অন্যায়
ও অপরাধ। যেখানে সাপের বাড়ি, পাখির বাড়ি সেখানে মানুষ ঢুকে পড়েছে। আর সবকে তাড়িয়ে মানুষ
বাড়ি বানিয়েছে। আকাশ-বাতাসের মতো নদী ও খাল মানুষের সম্পদ নয়। তা প্রকৃতির, রাষ্ট্র
সেগুলোকে হেফাজতে নেয়। মানুষের প্রয়োজন কখনও ফুরাবে না। সেই প্রয়োজনকে হাতিয়ার করে
রাষ্ট্রের বর্তমান পরিচালন শক্তি যদি সেগুলোকে যথেচ্ছ বিতরণ করে, আগামী সময় তার তিলে
তিলে প্রতিশোধ নেবে। জলের প্রবাহ থামিয়ে, জল দুষিয়ে, জৈব-বৈচিত্র কমিয়ে মানুষকে রুগ্ন,
ভগ্ন করে তুলবেই। নদীর পাড়, খালের পাড়, পাড়ে পড়ে থাকা বাবলার গোড়ায় যে নির্জনতা, যে
শান্তি, পাখির কলরবের মধ্যে যে শান্তি, তা নষ্ট করা মানেই হল আমাদের শান্তিকে নষ্ট
করা। নদী খালের বুকে বাঁধ পড়েছে, প্রবাহ নেই, নদী-খাল বুজে যাচ্ছে, গ্রাম ধোয়া যে আবর্জনা
জলস্রোত টেনে নিয়ে যেত, সেগুলো এখন গ্রামেই থাকছে। গ্রামের মাটি হয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত।
জল না সরার দরুণ জলাবদ্ধতা তৈরী হচ্ছে, ফসল মার খাচ্ছে। দেখলাম বিশাল আয়োজনে ইটের ভাঁটা
তৈরী হয়েছে। যতটুকু ডিসিআর কেটেছে, কার্যক্রম ততটুকুতে আটকে নেই। ছড়িয়ে পড়েছে আরও বেশি
জায়গায়।
যেটুকু ফাঁকা, যেটুকু নির্জনতা এখনও রয়েছে,
তা থাকুক। আর যেন নষ্ট না হয়। নদীর পাড়, খালের পাড়, যেসব জায়গায় চর জাগছে, অন্তত বিশ
বছরের মধ্যে সেসব স্থানে ডিসিআর দেওয়া বন্ধ থাকুক। ডিসিআর দিলে কেউ যেন আবাস বা বাড়ি
বানাতে না পারে সে শর্ত দেওয়া হোক, শুধু ফসল ফলানোর জন্য ডিসিআর দেওয়া যেতে পারে। অবৈধ
দখল যদি কেউ করে থাকে, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে তাদের তুলে দেওয়া হোক।
মানুষের পদচারণা যদি অন্য জীবের পদচারণাকে
ব্যাহত করে, মানুষের জন্য তা সুখের হলেও প্রকৃতির জন্য সুখের নয়। প্রকৃতি সকলের জন্য
সহাবস্থান তৈরী করেছে। মানুষ যদি নিজের প্রয়োজনে সেই সহাবস্থান অসহনীয় করে তোলে, তাতে
প্রকৃতি অখুশি হবে। অখুশি প্রকৃতি আমাদেরকে খুশি রাখবে না।