Wednesday, June 28, 2017

শ্রদ্ধার্ঘ : তিনি-ই আমার সক্রেটিস

বাংলা ক্লাসটা মিস করতাম না। ঝমঝম করে বৃষ্টি,কাদা রাস্তা,সাইকেল চড়ে যাওয়া যাবে না- ছাতি নিয়ে পায়ে হেঁটে চলে যেতাম ছয় কিলোমিটার। বৃষ্টিস্নাত কলেজের মাঠ ফাঁকা, লম্বা বারান্দায় গুটিকতক শিক্ষার্থী, টিচার্স রুম প্রায় শূন্য, অনেক শিক্ষক ছাত্রাভাবে ক্লাস নিতে না পেরে চলে গেছেন- শুধু তিনি রয়েছেন, টিচার্স রুমের একপাশে বসে, খোলা জানালার মেঘলা আলোয় বই খুলে। বিদ্যুৎবিহীন মেঘাচ্ছন্ন দিনে টিচার্স রুমের সামনের অন্ধকার তাঁর পর্যন্ত গিয়ে আলো হয়ে যেত। এই দুর্যোগে তাঁর ছাত্ররা আসবেই- এমন একটা বিশ্বাস ছিল, ছাত্রদের মনোভাব বোঝার ক্ষমতা প্রকৃত শিক্ষকের থাকে-ই। স্কুলে হাজিরায় যদি মার্কস থাকতো- আমি সবচেয়ে কম মার্কস পেতাম-এটা নিশ্চিত। কিন্তু কলেজে উঠে আর সেটা হয় নি। আমার মত  অনেক অনিয়মিত শিক্ষার্থীকে কলেজমুখি করেছিলেন তিনি, তবে সেটা এমনি এমনি হয়নি।

আমার শুরুটা হয়েছিল  মাইকেল মধুসূদন দত্তের "আত্ম বিলাপ" কবিতাটির ক্লাসে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই-বা কম কী করিল?" ( শিক্ষা। শিক্ষার বাহন)। প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব তাঁর পাঠদানের প্রক্রিয়াতে ফুটে উঠেছিল,পরে তা বুঝেছিলাম। কবিতা জীবনাপোলব্ধির ফসল। মাইকেলের "আত্মবিলাপের" পিছনে যে জীবনবোধ লুকিয়ে ছিল,তা মাইকেলের মত-ই বুঝিয়ে ছিলেন তিনি। অসম্ভব প্রতিভাধর মাইকেল মধুসূদন দত্ত "ক্ষুদ্র বাংলা"কে উপেক্ষা করে বিশাল ইংরেজ দুনিয়ায় হোমার এর "দি ইলিয়াড এন্ড দি ওডিসি"র মত কাব্য লিখে অমর হতে চেয়েছিলেন, ইংরেজ দেশে গিয়ে ইংরেজ বিয়ে করে ইংরেজদের সাথে মিশে ছিলেন, কিন্তু যখন দেখলেন- ইংরেজরা কৃপণ,তাঁরা বাইরের কাউকে নিজেদের মধ্যে স্বাগত জানায় না,তা সে যত উন্নত সৃষ্টি ও শিল্প-ই হোক না কেন-তখন জীবনের বহুলাংশ ব্যয় হয়ে গেছে, মাইকেলের এই জীবনাভুতির বিলাপ তিনি এমন ভাবে বুঝিয়ে ছিলেন যে তা " অন্তরে ঘা বসাইয়া" দিয়েছিল। তারপর থেকে " আত্মবিলাপ" এর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আমার জানা হয়ে গিয়েছিল,তা আজও মনে আছে, শুধু তা-ই নয় ,  মাইকেল মধুসূদন দত্ত  সম্পর্কে তারপর  আর বিশেষ কিছু পড়ার প্রয়োজন পড়েনি।

"আত্মবিলাপ" ক্লাসের মত অসংখ্য ক্লাস আমার ছাত্র জীবনের বৃক্ষটিতে মুকুল হয়ে ফুটে ছিল , পরবর্তীতে যার পুষ্ট ফল বস্তু বিশ্বে আমাকে পথ দেখিয়েছে আবার  আত্ম-বিচারেও বিবেচনা শক্তি জুগিয়েছে। জীবনে কখনো চাকরির পরীক্ষায় ফেল করিনি। অনেকেই এখন ভাবেন - টাকা পয়সা আর ধরাকরা না থাকলে চাকরি পাওয়া যাবে না।  কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয় নি, শুধু আমি নই , আমার মত তাঁর অসংখ্য প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীর কাছে তা মনে হয়েছে বলে জানা নেই। গোটা দুই নোট আর সংক্ষিপ্ত সাজেশন নিয়ে পরীক্ষায় পাস করা , আর চাকরির পরীক্ষায় পাস করা এক নয়। সিলেবাসের বাইরে নিজেকে প্রস্তুত করা এবং যে কোন পরিস্থিতিতে " আমি পারবো ও পারি" এমন মানসিকতা থাকাটা বড় কথা। যদি প্রকাশের ক্ষমতা থাকে তাহলে মাত্র পাঁচ টি শব্দেই পাঁচটা পাতা লেখা যায়, প্রকাশের ক্ষমতাটা রপ্ত করতে হয়, চারপাশের ঘটনাবলী, নিজের অনুভূতি লিখে লিখে এ ক্ষমতা আয়ত্ত করা যায়।

আমার  অজান্তেই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন চারপাশের জীবন-চরিত আর প্রকৃতির মধ্যে লুকায়িত সত্যের হাতছানির দিকে , তাই এখনকার অতি মাত্রার ভোগবাদ ও বস্তুবাদের মধ্যে যখন নিজেকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছি, তখনই "কিছু করতে না পারা" আর "কিছু না দিতে পারা"র যন্ত্রনা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত বারে বারে অনুভূত হয়েছে।  মানুষ হবার জন্য এটা জরুরি, তিনি-ই প্রথম চোখ ফুটিয়েছেন। এখানেই দেশকালের গন্ডি পেরিয়ে  প্রকৃত শিক্ষকদের একটা মিল, তা সে খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের কনফুসিয়াস হোন আর তার পরবর্তীতে জোহান আমোস কমেনিয়াস অথবা জন লক কিংবা ফ্রেডরিক ফ্রয়েবল হোন।  যখন শুনি পরীক্ষার সকালে শিক্ষক ফেসবুক কিংবা হোয়াটসআপ এ প্রশ্ন ফাঁস করে লিখছেন " তোমাদের জন্য সারারাত জেগে এই কষ্ট করেছি" তখন লজ্জা লাগে, এ লজ্জাবোধ তাঁর কাছ থেকে শেখা। অবশ্য এ লজ্জার জন্য আমাদের রাষ্ট্রও  দায় এড়াতে পারেনা। অনুদার নীতি ও দৃষ্টি’র কঞ্জুসপনা দিয়ে অগণিত শিক্ষকদের বেঁধে রেখে প্রকারান্তরে শিক্ষার স্রোতটিকেই আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে, উদার না হলে, অন্ততঃ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবসাটা দিন কে দিন আরো জমবে।

প্রকৃত শিক্ষক যেখানেই থাকেন সেটিই ক্লাস রুম। তাঁর সান্নিধ্যে সেটা বুঝেছিলাম। আমরা যারা পঁচাত্তর পরবর্তীতে স্কুলে গিয়েছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে পাঠ্য বইতে সামান্যই জানতে পেরেছি। দেশের রাজনীতির দীনতা বাচ্চাদের মধ্যেও ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা ছিল। তাঁর সামান্য একটি স্মৃতিচারণে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পেয়েছিলাম পাঠ্য বইয়ের বাইরে । একদিন আমাদের কয়েক জনকে ডেকে নিয়ে গেলেন তার ছোট্ট প্রেস ঘরে। কালীগঞ্জ থানা রোডের একটা শাখা পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে কাঁকশিয়ালি নদীর খেয়া ঘাট ছুঁয়ে শিল্পকলা একাডেমির দিকে চলে গেছে।  খেয়া ঘাটে ওঠার আগে রাস্তার পুব পাশে ছিল তাঁর প্রেস ঘরটি, মাঝে দেওয়ালের একপাশে আওয়ামীলীগ এর কার্যালয়।  লোকজন বেশি বলে আমাদের রাস্তার ঠিক ওপাশে একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন, কার্তিকের হোটেল, গোলপাতার ছাওনি, ভাঙা মেঝের ওপর গুটিকতক টেবিল চেয়ার সাজানো, খদ্দেরপাতি বেশি নেই। তাঁর মুখোমুখি একটা খোঁড়া টেবিল সামনে রেখে বসলাম। চোখেমুখে কিসের যেন  একাকিত্ব ফুটে উঠেছে । কদিন ধরে টিচার্স রুমে গন্ডগোল চলছিল, আমরা তার খবর রাখিনা। তিনিও সেটা কখনো বলেন নি, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষকদের সাথে তাঁর সময় মোটেই ভাল যাচ্ছিল না, সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। খুব নিশ্চুপ ছিলেন তিনি, কিছু প্রশ্ন করবো- তার সাহস পাচ্ছিলাম না, পরে তিনি-ই বললেন ," কদিন পরেই পনেরই আগস্ট, একটা স্মৃতির কথা খুব মনে পড়ছে,তোমাদের সাথে ভাগ করলে ভালো লাগবে।"  আমরা শুনতে আগ্রহী হলাম। তিনি বললেন , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে নেপালে  শিক্ষা সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এ জন্য সরকারী অনুদান প্রয়োজন । অনুদান সংগ্রহের জন্য বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁরা, মিডিয়া ছিলেন তোফায়েল আহমেদ ( বর্তমান বাণিজ্য মন্ত্রী), যুদ্ধপরবর্তি দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি মেরামতে বঙ্গবন্ধু তখন মহাব্যস্ত। বিদেশি ডেলিগেটদের সাথে একটা মিটিং করছিলেন, তোফায়েল আহমেদ তাঁদেরকে অপেক্ষা করতে বললেন। মুনির চৌধুরী-আনোয়ার পাশা-মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী'র এই বাংলা বিভাগের ওপর বঙ্গবন্ধুর মনোযোগ ছিল, সন্ধ্যার দিকে তিনি সাক্ষাৎ দিলেন। নেপালে যাওয়ার যুক্তি ও ইচ্ছার কথা শুনে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন ," তোরা গলাচিপায় গিছিস?" তারপর বললেন "খুব সুন্দর জায়গা, আমি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি, আগে নিজের দেশটা ঘুরে ঘুরে দেখ, তারপর নেপাল যাস।" তাঁদের মাঝে একটা নীরবতা নেমে এলো, সত্যিই তো গলাচিপায় যাওয়া হয় নি। বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহমেদকে তাঁদের  জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন , বললেন , " তেলের ব্যবস্থা তোমাদের বিভাগ কে করতে হবে, রাজ কোষের অবস্থা ভালো না।"

দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর অহমবোধের কথা সেই প্রথম তাঁর মুখ দিয়েই জানতে পেরেছিলাম একটি হোটেলে বসে । সেই থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তীব্র আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল। বলতে পারি সে আকাঙ্খা তিনিই জাগিয়েছিল। দেশের সকল ক্ষেত্রের সাথে পাঠ্যসূচিতেও  নির্বাসিত বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছিলেন ," দেশের সত্য ইতিহাসটিকেও চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে" তারপর বলেছিলেন " হীন মানসিকতা বিশালত্বের নাগাল পায় না কখনো,তোমাদেরকে সত্য জানতে হবে।"  তাঁর কথায় একটা প্রচ্ছন্ন আন্দোলনের ডাক বয়ে গিয়েছিল কার্তিকের সেই ছোট্ট হোটেলটিতে, পাশেই বয়ে যাওয়া কাকশিয়ালির বুকে তখন স্রোতের কলকল ধ্বনি। সে ধ্বনিতে বেজেছিল " সময় হয়েছে,সময় আসছে।" পরে ছাত্ররা আওয়ামীলীগের ছাত্র রাজনীতিতে মুখর হলো, স্যার বললেন " হাততালি দেওয়ার লোক জোগাড় করো, বক্তব্যের প্রতিটি লাইনের শেষে যেন হাততালি পড়ে।" আমরা তাই করতাম, ক্রমে একেকটি সমাবেশ থেকে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়তো সবখানে, তিনি ডাক দিয়ে গেলেন, তখন কালীগঞ্জে আওয়ালীগে ঐক্য ছিল, আজ নেই, পুরো সাতক্ষীরাতেই নেই, এই অনৈক্য না জানি আবার পেছন দিকে নিয়ে যায়।

তাঁর আমন্ত্রণে ১৯৯৫ সালে একবার কবি নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী,সমুদ্রগুপ্ত ,পশ্চিম বঙ্গের কানাই সেন,অমিতাভ চক্রবর্তী সহ অনেক সুধীজনের সমাবেশ হয়েছিল সাতক্ষীরায়। এতগুলো সুধীজনকে একত্রে আমি আর কখনো দেখিনি। তিনি বলেছিলেন ," তোমার যা ভালো লাগে তাই লিখবে, যার যা ভালোলাগে তাই লেখা উচিত,জোর করে চাপালে খারাপ হতে পারে।" একটি কবিতা লিখে আবৃত্তি করেছিলাম। আমার কবিতা শুনে কবি আসাদ চৌধুরী ঢাকায় ফিরে আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন, আজো সেই চিঠি আমার কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে, কাগজপত্রের মাঝে তা আমি আজও রেখে দিয়েছি। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন " তোমাদের ওখানে এমন এক পরশ পাথর তোমরা পেয়েছ, যার সান্নিধ্যে তোমরা সোনা হতে পার।" আমার স্যার যে সত্যিই পরশপথর তা অনেকপরে আজ বুঝেছি, লজ্বা লাগে- জ্বলে উঠতে পারিনি। কালিগঞ্জ কলেজের রজত জয়ন্তিতে শ্রেষ্ঠ কৃতি ছাত্রের সম্মাননাও পেয়েছি, গলায় কাঁটার হার হয়ে তাও লজ্বা দেয় আমায়। সারাদিন ব্যাংকের কাজ, দিন শেষে তার - ই ঝাঁজ। চাকরি পাওয়ার আগে সোনার হরিণ ধরার স্বাদ, চাকরি পেয়ে মনে হয়- বিধাতার অন্যায়। কিন্তু মনের মধ্যে সেই "যন্ত্রনা" বা তাগিদ হেঁকে যায়, কারন তাঁর কাছে যে গল্প শুনেছি,মানুষের গল্প, সীমা ছাড়িয়ে অসীম হওয়া মানুষের গল্প, এখন ছেলেমেয়েদের খুব একটা জীবনী গ্রন্থ পড়তে দেখিনা, এটা অন্যায়, ঈশ্বরের জীবনী পড়ে লাভ নেই,ঈশ্বর অপার-অসীম,  মানুষের জীবনী পড়তে হয়, সেখানে সীমার মধ্যে অসীম হওয়ার গল্প থাকে, তিনি গল্প করতেন জীবনের, গল্প করতেন দান্তের,যিনি ভুক্তভোগীর কথা শুনতে শুনতে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, গল্প করতেন চেখভের,রোমা রোলা’র, গান্ধীর, মুজিবের, জীবনানন্দের, ও’ হেনরি'র - যিনি ব্যাংকে চুরির দায়ে জেলে বসে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন, গল্প করতেন কাওয়াবুচি, রবীন্দ্রনাথ, হেমিংওয়ের- যিনি একশ পাতার ছোট উপন্যাস একশ বার লিখে নোবেল পেয়েছিলেন ( দি ওল্ড ম্যান এন্ড দি সী - ২৬০০০ শব্দের), গল্প করতেন খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ  (রহ:) কে নিয়েও। এঁদের প্রায় সকলের ওপর তাঁর মৌলিক রচনা ও গবেষণা রয়েছে। এসব মানুষের অসীম হয়ে ওঠার গল্প তাঁর কাছে শুনেছি বলেই জীবনে অনেক কঠিন সমস্যায় বল পেয়েছি, এখনো কিছু করার শক্তি পাই, হারাই নি আমি। ছোটবেলায় মা-ঠাকুমার কোলে শুয়ে যে গল্প শোনা হয় ,তা জীবনকে প্রভাবিত করে রাখে। চাঁদের বুড়ির গল্প শুনে মানুষ চাঁদে যেতে পেরেছে, গোল্ডিলোকস আর তিন ভালুকের গল্প শোনা হয়েছে বলেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে নাসা গোল্ডিলোকস বা হ্যাবিটেবল এলাকা খুঁজে বেড়াচ্ছে মহাকাশ চষে ( জ্যোতির্বিজ্ঞানে বলা হয় আমাদের পৃথিবী গোল্ডিলোকস অঞ্চলে অবস্থিত) । গল্প শোনার মধ্যে চরিত্র তৈরি হয়, দুঃখী’র গল্প শুনে দুঃখবোধ তৈরি হয়, নৃশংসতার গল্প শুনে ঘৃণাবোধ তৈরি হয়, বীরের গল্প শুনে বীরত্ব তৈরি হয়, আজ শিশুদের গল্প শোনানো হয় না, চারিদিকে হানাহানি- রক্তারক্তির এটি একটি অন্যতম কারণ।

আত্মার টানে বাড়িতে থাকতে পারতাম না, তিনি আমাকে মন্ত্রের মত টানতেন, তাই কলেজের গন্ডি পেরিয়েও কারনে- অকারণে চলে যেতাম স্যারের বাড়িতে। দেখতাম, গাছগাছালির মধ্যে নিজ বাড়ির রেলিং ঘেরা বারান্দায় অসংখ্য বইয়ের মধ্যে তিনি ডুবে আছেন। মার্ক টুয়েনের লাইব্রেরির কথা আমরা শুনেছি, ওরকম সময়ে একটা মফস্বলের বাড়িতে অবাক হয়েছিলাম বইয়ের সংগ্রহ দেখে, ইমরুল ইউসুফ ( স্যারের বড় ছেলে,বাংলা একাডেমিতে কর্মরত) একদিন দোতলায় নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে কেউ থাকে না, শুধু বই থাকে,বই আর বই, যেন দোতলাটি বানানো হয়েছে বই রাখার জন্য। এরকম  একটা প্রত্যন্ত এলাকায় বসে নিভৃতে তিনি গবেষণা করে গেছেন। বলেছি ," আপনি ঢাকায় থাকতে পারতেন, অনেকের সাথে আপনার যোগসূত্র রয়েছে।" এককথায় উত্তর " তোমাদের ছেড়ে যাই কিকরে বলো।" দেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগাঁথার কথকসহ অনেক কিছু অন্ধকার থেকে আলোয় এনেছেন নিভৃতে বসেই, সেসব কষ্টসাধ্য আবিষ্কার আমাদেরকে পথ দেখায়। দেশ-কাল-সমাজবোধের ভিত্তিতে তাঁর সাহিত্য সমালোচনা, মৌলিক গবেষণা অথবা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কর্মসৃষ্টিকে আজকের প্রেক্ষাপটে সাযুজ্যপূর্ন করে তুলে তার ভাবধারাকে জনমনে কার্যকরভাবে প্রোথিত করার প্রয়াস- সত্তর দশকের শেষার্ধ থেকে আশির দশকে বাংলাদেশের সমাজে ঢুকে যাওয়া রাজনৈতিক স্বার্থবাদী অন্ধ উগ্রবাদের উপর তাঁকে সমাজ-সংস্ককারকের ভূমিকায় উপনীত করেছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ গুলো দেখলে তা বোঝা যায়।  " অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান" -কে ছাড়িয়ে তা অনেক উপরে। তাঁর সে সব বিশ্বমানের কর্ম ও সৃষ্টি নিয়ে এখানে বলার অবকাশ নেই, সেটা অতীব গভীরের বিষয়, কেননা জানি, একটি শব্দও তিনি অনর্থক চয়ন করেন নি, তা নিয়ে আলাদা ভাবে কিছু করার ইচ্ছা আমার আছে, এটা বলতে পারি, তাঁর কর্ম ও সৃষ্টির উপর লেখালেখি বা আলোকপাত খুব কম হয়েছে, শুভ্র আহমেদ কিছু চেষ্টা করেছেন, আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাই।

একদিন আমাকে ডেকেছিলেন, ঋজু শরীরে খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা স্যারের হাতে ছিল একটা খাতা। বললেন , " খুলনা রেডিওতে "সক্রেটিস" নাটক রেকর্ড হবে, কালীগঞ্জের নাট্য গোষ্ঠীর নামে, তোমাকে প্লেটোর ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে।" মনে মনে ভেবেছিলাম, গাজী কালু চম্পাবতীর দেশে সক্রেটিস কি জমবে? কিন্তু না, এ অঞ্চলের অবহেলিত - সংবেদনশীল মানুষের মনে সক্রেটিসের সংলাপগুলো জায়গা করে নিয়েছিল। নিজের লেখা নাটকে তিনি নিজেই সক্রেটিসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কাকশিয়ালির পাড়ে ভগ্ন শিল্পকলা একাডেমিতে  চলতো রিহার্সাল। যখন সুর করে গাইলেন " হও ধর্মেতে ধীর,হও কর্মেতে বীর, হও উন্নত শির-নাহি ভয়।"   অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমরা, কি অপূর্ব দরাজ কন্ঠ! দাঁড়িয়ে যখন গাচ্ছিলেন, আমরা বসে। মনে হচ্ছিল সূর্য থেকে একমুঠো আলো এনে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক গুণী, যেন চিরকালের ত্রাণকর্তা, পাশের রাস্তায় পথিকেরাও থেমে গিয়েছিল- তা শুনতে। সেদিন তিনি প্লেটোর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য কেন আমাকে বেছে নিয়েছিলেন - তা ভাবতে গিয়ে মনের মধ্যটা খচখচ করে ওঠে। নাটকে আমার একটি ডায়লগ ছিল। প্রিয় শিক্ষক সক্রেটিসকে হেমলক বিষ পান করানোর সময় চিৎকার করে প্লেটো আক্ষেপে বলেছিলেন , " হায় ঈশ্বর! যে দেশ জ্ঞানীর কদর বোঝেনা, সেই দেশে আমাকে জন্ম দিয়েছিলে কেন।" প্লেটোর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে সেই ডায়লগটি আমার জীবনের সাথে এখনো মিশে আছে, তাঁর সত্তরতম জন্মদিনে সেই ডায়ালগটির আবেদন আমাকে আঘাত করে যায়, কারন, তিনি-ই আমার সক্রেটিস।

Saturday, June 24, 2017

গান

আমি সেই কথাটি বলার জন্য বলে যাই।
যে কথাটি হয়নি বলা
যার জন্য হাজার বলা,
বলো তারে কোথায় পাই
আমি তারে কোথায় পাই।
আমি সেই কথাটি বলার জন্য বলে যাই।

নিশিদিন জেগে থাকি
মরনটারে ভুলিয়ে রাখি,
সুখের জালে দুঃখ ঘিরি
বলো আর কত পারি।
আমি আর কত পারি।।

বৃষ্টি আসে ঝমঝমিয়ে
রংধনুতে লাগে রং,
তোমার সাথে যত কথা
সব ছিল না কিছু ঢং।।

সাগর তীরের ঝঞ্জা মেখে
ফাগুন রাতে বেয়ে যাই,
তোমার কাছে পূর্ণিমাতে
সেই কথাটি বলতে চাই।
আমি তারে কোথায় পাই।
বলো তারে কোথায় পাই।।

আমি সেই কথাটি বলার জন্য বলে যাই।
যে কথাটি হয়নি বলা
যার জন্য হাজার বলা,
বলো তারে কোথায় পাই
আমি তারে কোথায় পাই।
আমি সেই কথাটি বলার জন্য বলে যাই।

( রচনাকাল : ২৪ জুন,২০১৭। দক্ষিনশ্রীপুর)